দেশে ফিরতে চায় কক্সবাজারে ক্যাম্পে থাকা সাধারণ রোহিঙ্গারা। যে কোনো মূল্যে দেশের মাটিতে নিজ ঘরে যেতে চায় তারা। প্রত্যাবাসনের সুযোগ কাজে লাগাতে চায় রোহিঙ্গাদের বড় একটি অংশ। শুধু রোহিঙ্গাদের বিশেষ একটি গোষ্ঠী যারা বিভিন্ন অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে ও ক্যাম্পে অবস্থানের অপব্যবহারকারীরাই ফিরতে চায় না। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থার মদদপুষ্ট রোহিঙ্গাদের একটি অংশ। জানা যায়, উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় প্রত্যাবাসন ইস্যুতে পক্ষে বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন রোহিঙ্গারা। ৫ মে ২০ সদস্যের রোহিঙ্গা প্রতিনিধি দল মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের জন্য প্রস্তুতকৃত অবকাঠামো পরিদর্শন শেষে ফিরে সাংবাদিকদের প্রত্যাবাসন বিষয়ে নেতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করেন। তবে তাদের সেই মনোভাবের প্রতি সমর্থন দিতে নারাজ ক্যাম্পের অন্য রোহিঙ্গারা। রোহিঙ্গাদের সচেতন একটি অংশ বাংলাদেশে আশ্রিত হিসেবে থাকতে অনাগ্রহ প্রকাশ করছে। তারা মিয়ানমারে ফেরার ব্যাপারে ক্যাম্পেইন করে ক্যাম্পের অন্য রোহিঙ্গাদের মধ্যে আগ্রহ জাগ্রত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রোহিঙ্গা নেতা বলেন, ভাসমান জীবনে আর কতদিন থাকব, এখন নিজ দেশে ফিরতে চাই। এ দেশে থেকে দাবি আদায় সম্ভব নয় উল্লেখ করে ওই রোহিঙ্গা নেতা আরও বলেন, দেশ ছেড়ে বিদেশের মাটিতে বসে হাজারো দাবি দিতে পারি, কিন্তু তাতে কোনো কাজ হবে না। আগে আমাদের নিজেদের দেশে যেতে হবে, সেখানে থাকতে হবে, মাতৃভূমির ওপর দাঁড়িয়ে তারপর যত দাবি বিশ্ববাসীকে দিতে পারি। ফিরতে অনাগ্রহী রোহিঙ্গাদের প্রসঙ্গে উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বয়োবৃদ্ধ আজমত আলী বলেন, যারা যেতে অনীহা দেখাচ্ছে তারা সেখানে নিরাপত্তার অজুহাত দিচ্ছে, নাগরিকত্ব দাবি করছে। আমাদের ধারণা, আমরা মিয়ানমার ফিরে গেলে আমাদের নিরাপত্তায় কোনো ধরনের ব্যাঘাত হবে না। মিয়ানমার আমাদের পূর্ণ নিরাপত্তা দেবে, কারণ আমাদের ওপর পুরো দুনিয়ার মানুষের নজর থাকবে। প্রত্যাবাসিত রোহিঙ্গাদের ওপর নতুন করে নির্যাতন হলে সেটি বিশ্ব সম্প্রদায়ের নজরে আসবে, তাই মিয়ানমার সহজে এমনটি করতে চাইবে না।
টেকনাফ নয়াপাড়া নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা আবদুল হামিদ বলেন, বাংলাদেশে পাহাড়ে আমরা এত বেশি সুখে নেই। আমাদের জাতির সন্ত্রাসীদের হাতে প্রতিনিয়ত রোহিঙ্গারা খুন হচ্ছে। বলতে গেলে এখানেও তো কোনো নিরাপত্তা নেই। সেখানে আমরা রাখাইনে নিরাপত্তার অজুহাত দিয়ে ফেরার পথ রুদ্ধ করতে যাচ্ছি, এটি রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারের গলিতে ঠেলে দেবে।
উখিয়ার একজন রোহিঙ্গা যুবনেতা জানান, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে কীভাবে ফিরবে, সেখানে কী কী সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে, কীভাবে বসবাস করবে এসব বিষয় রোহিঙ্গাদের কাছে পরিষ্কার নয়। কেউ এ বিষয়ে রোহিঙ্গাদের বিশদভাবে ব্রিফ করেনি। রোহিঙ্গাদের আগে এসব বিষয়ে জানাতে হবে, রাখাইনে ফেরার ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের মনের ভয় দূর করতে হবে। তাদের বুঝাতে হবে, যেমনটি ভাসানচরের ক্ষেত্রে ঘটেছে।
সাধারণ রোহিঙ্গারা বলছেন, নিরাপদ ও সঠিক প্রত্যাবাসনের দাবি তুলে রোহিঙ্গা নেতারা রাখাইন যেতে অসম্মতি জানাচ্ছেন। প্রকৃতপক্ষে রোহিঙ্গা শিবিরে ত্রাণ ও নগদ অর্থ সাহায্য ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগ হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কায় তারা মিয়ানমার যেতে চাচ্ছে না। বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দাতা দেশ ও সংস্থাগুলো অর্থ বরাদ্দ কমালেও রোহিঙ্গারা চলমান সুযোগ-সুবিধা ছাড়তে রাজি নয়।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মো. মিজানুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা দীর্ঘদিনের, এটি এক দিনে সমাধান হবে না। তবে এ সমস্যার সমাধানে প্রত্যাবাসনের কোনো বিকল্প নেই। মিয়ানমার সরকার এবং রোহিঙ্গাদের পরস্পরকে ছাড় দিতে হবে, তবেই প্রত্যাবাসন সম্ভব। এ বিষয়ে মিয়ানমার প্রতিনিধিদল আবারও কক্সবাজার আসবে, রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলবে। প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে মিয়ানমারের যথেষ্ট সদিচ্ছা লক্ষ করেছি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, চলতি মাসেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করতে চায় বাংলাদেশ। মিয়ানমারও এতে সায় দিয়েছে। প্রভাবশালী রাষ্ট্র চীনের মধ্যস্থতায় পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে প্রত্যাবাসন কার্যক্রম শুরু হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধা ঘোষণা করেছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিশাল রোহিঙ্গার বোঝা ঘাড় থেকে নামাতে চায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পক্ষে এ বোঝা বহন করা আর সম্ভব হচ্ছে না। মানবিক বিবেচনায় প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ আশ্রয় দিলেও শিবিরে রোহিঙ্গারা মাদক চোরাচালান, সন্ত্রাসসহ বিভিন্ন অপরাধ কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ছে। প্রায়ই ক্যাম্পে গোলাগুলিসহ সংঘর্ষ চলছে। ক্যাম্পের বাইরে ইয়াবা পাচার, চুরি-ছিনতাইসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে চলে যাচ্ছে যে, বাংলাদেশের স্থানীয় জনগণই নিজভূমে পরবাসীর মতো দিনযাপন করছে। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে যাওয়া বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্যরা রাখাইনের পরিবেশ দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেন। রাখাইনের পরিবেশ-পরিস্থিতি অনেক ভালো দাবি করে তারা বলেছেন, ছয় বছর আগে রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন এলাকা থেকে ৮ লাখের বেশি রোহিঙ্গা নাফ নদ অতিক্রম করে বাংলাদেশে আশ্রয় নিলেও মংডু শহরে রোহিঙ্গাদের নড়চড় হয়নি। প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে রাখাইন যাওয়া সরকারি সংস্থার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মংডু শহরে রোহিঙ্গা মেয়েরা স্বাধীনভাবে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। মংডুর মডেল ভিলেজ বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের তুলনায় অনেক উন্নত। মডেল ভিলেজে যারা থাকবেন, তাদের প্রতিটি পরিবারে (রোহিঙ্গা) চাষাবাদের জন্য ১ একর করে জমি বরাদ্দ দেওয়া হবে, স্কুলে রোহিঙ্গা ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরি ও স্বাধীনভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য করার সুযোগ থাকছে। মডেল ভিলেজে হাসপাতাল, মসজিদ ও খেলার মাঠ রাখা হচ্ছে, যা অতীতে রোহিঙ্গা বসতিতে ছিল না। রোহিঙ্গাদের উচিত সুযোগটি কাজে লাগানো।