আজকের পত্রিকা

কয়লা খালাসে জটিলতায় তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো

দেশের তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর জন্য আমদানি করা কয়লা পরিবহনের বিপরীতে বন্দরের চ্যানেলের রক্ষণাবেক্ষণ ফি চায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। চ্যানেলের নাব্য ঠিক রাখতে এই ফি চেয়েছে দেশের সবকটি বন্দর কর্তৃপক্ষ। এমনকি সম্প্রতি কয়লাবোঝাই জাহাজ বন্দরে ভিড়লেও ফি পরিশোধ না করায় কয়লা খালাস করতে পারছে না একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষ।

Play Video

বিদ্যুৎকেন্দ্র সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কয়লা পরিবহনে বন্দরের চ্যানেল রক্ষণাবেক্ষণ ফি আদায় করা হলে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। আর উৎপাদন ব্যয় বাড়লে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দামে। তাদের মতে, দেশের বন্দরগুলোর চ্যানেলের যে পরিমাণ নাব্য থাকা প্রয়োজন, সেটা নেই। এ কারণে বড় জাহাজ থেকে কয়লা ছোট ছোট লাইটারেজ জাহাজে পরিবহন করে খালাস করতে হয়। এতে বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষের খরচ বেশি হয়। এ অবস্থায় বন্দরের রক্ষণাবেক্ষণ ফি পরিশোধ করতে হলে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিকল্প থাকবে না।
বিদ্যুৎ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় নির্মিত ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য গত সপ্তাহের শেষে ৫৬ হাজার ৬১৪ মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে পায়রা বন্দরে নোঙর করে একটি জাহাজ। তবে বন্দর কর্তৃপক্ষ জাহাজটিকে কয়লা খালাস করতে না দিয়ে চ্যানেলের নাব্য ঠিক রাখতে রক্ষণাবেক্ষণ ফি হিসেবে প্রতি টন কয়লার বিপরীতে সাত দশমিক ৭১ ডলার দাবি করে।

Play Video

আরপিসিএল-নরিনকো ইন্টারন্যাশনাল পাওয়ার লিমিটেড (আরএনপিএল) নামে যৌথ উদ্যোগে পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণ করেছে চীনা নির্মাণ প্রতিষ্ঠান নরিনকো ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন লিমিটেড ও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (আরপিসিএল)। কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট আগামী মার্চে বাণিজ্যিক উৎপাদনে আসবে। দ্বিতীয় ইউনিট উৎপাদনে আসবে আগামী জুনে।

Play Video

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, আগামী সপ্তাহে কেন্দ্রটির ৬৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি ইউনিট জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে সংযুক্ত করা হবে; কিন্তু এখনো কয়লা খালাসের বিষয়টি নিশ্চিত না হওয়ায় এই প্রক্রিয়া পেছাতে পারে। এ অবস্থায় চ্যানেল রক্ষণাবেক্ষণের ফি ছাড়া কয়লা খালাসের জন্য গত রোববার পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানকে চিঠি দেন আরএনপিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সেলিম ভূঁইয়া। চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, চ্যানেল রক্ষণাবেক্ষণ ফি পরিশোধের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত প্রদানের জন্য পিডিবিকে পত্র দেওয়া হয়েছে। পিডিবি থেকে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত না পাওয়ায় চ্যানেল রক্ষণাবেক্ষণ ফি ছাড়া অন্যান্য ফি পরিশোধ করে কয়লা আনলোড করতে ইচ্ছুক। চিঠিতে আরও বলা হয়, যদি চ্যানেল রক্ষণাবেক্ষণ ফি পরিশোধ না করার কারণে বন্দর কর্তৃপক্ষ কয়লা আনলোডিং কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়, তাহলে আরএনপিএলকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, যা রাষ্ট্রের ক্ষতি বলে বিবেচিত হবে, যা পরবর্তী সময়ে উচ্চ বিদ্যুৎ মূল্যরূপে গ্রাহক পর্যায়ে পড়বে।

Play Video

এই চিঠিতে বিপরীতে গতকাল পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের উপ-পরিচালক (ট্রাফিক) আজিজুর রহমান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে আরএনপিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে জানানো হয়, নির্ধারিত চ্যানেল রক্ষণাবেক্ষণ ফি পরিশোধের পূর্বে কয়লা খালাসের অনুমতি প্রদান করা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে শিগগির আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হবে।

আরএনপিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সেলিম ভূঁইয়া কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা কয়লা এনে খালাস করতে পারছি না। বিষয়টি আমি বিদ্যুৎ সচিবকে জানিয়েছি। তিনি নৌপরিবহন সচিবের সঙ্গে কথা বলেছেন। আমরা বলেছি, আপাতত চ্যানেল রক্ষণাবেক্ষণ ফি ছাড়া অন্যান্য ফি পরিশোধ করে কয়লা খালাসের অনুমতি দিতে।’

তিনি বলেন, ‘চ্যানেলের রক্ষণাবেক্ষণ ফি দিলে আমাদের ব্যয় বাড়বে। কারণ বর্তমানে পায়রা চ্যানেলে নাব্য ৫ দশমিক ৯ মিটার। ফলে ৪০-৫০ হাজার টনের ধারণক্ষমতার জাহাজ আসতে পারে না। বড় জাহাজ মাঝ সমুদ্রে রেখে লাইটারেজ জাহাজের মাধ্যমে কয়লা খালাস করতে হয়। এতে প্রতি টনে ৮ ডলার খরচ হয়। এখন রক্ষণাবেক্ষণ ফি দিতে গেলে খরচ দ্বিগুণ হবে। আর এই খরচ যদি শেষ পর্যন্ত থাকে তাহলে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বাড়বে। ফলে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দামও বাড়ানো হতে পারে।’

বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্ট এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, বিষয়টি নিয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বিদ্যুৎ বিভাগের আলোচনা চলছে। এর আগে এই ফি আদায়ে গত বছরের মে মাসে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে গেজেট প্রকাশ করা হয়। ফলে এই ফি আদায় করা হলে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে, এর কোনো বিকল্প থাকবে না। এ কারণে বিষয়টি নিয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমরা আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। আশা করছি এ মাসে বিষয়টি নিয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠক হবে। তারপরেও চ্যানেলের রক্ষণাবেক্ষণ ফি বলবৎ থাকলে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে অথবা পিডিবিকে লোকসান গুনতে হবে।

আরএনপিএলের এক কর্মকর্তা জানান, চলতি অর্থবছরে পটুয়াখালী বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ৬০ থেকে ৭২টি কয়লাবোঝাই জাহাজ আনার পরিকল্পনা রয়েছে। এই হিসাবে বছরে ৩৬০ কোটি টাকা চ্যানেল রক্ষণাবেক্ষণ ফি পরিশোধ করতে হবে। এর আগে গত ১৯ নভেম্বর নৌ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ ইউসুফের সভাপতিত্বে চ্যানেল রক্ষণাবেক্ষণ ফি আদায় বিষয়ে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় বাংলাদেশ চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের মালিকানাধীন পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিপরীতে চ্যানেল রক্ষণাবেক্ষণ ফি বাবদ ৮৩৯ কোটি ৬৫ লাখ ৯ হাজার ২২১ টাকা পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষকে পরিশোধের সিদ্ধান্ত হয়। এই টাকা ২০২৩ সালের এক জানুয়ারি থেকে ৩১ মার্চ এবং ২০২৩ সালের এক এপ্রিল থেকে ২০২৪ সালের ৬ নভেম্বর পর্যন্ত সময়ের চ্যানেল রক্ষণাবেক্ষণ ফি হিসেবে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ দাবি করে। এ ছাড়া মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিপরীতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ চ্যানেল রক্ষণাবেক্ষণ ফি বাবদ চারশ কোটি টাকা দাবি করেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *