১২:৪৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ ২০২৫, ৩ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আওয়ামী লীগকে ‘বড় দল’ ঘোষণায় সমালোচনা

চলতি শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবইয়ে দেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের পাঠে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। আওয়ামী লীগ আমলের একপক্ষীয় ইতিহাস বাদ দেওয়া হয়েছে। বাদ পড়েছে অতিরঞ্জন ও অতিবন্দনা। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ, যার যেটুকু অবদান, সেটিই তুলে ধরা হয়েছে। অবদানের স্বীকৃতির কারণে এবার স্বাধীনতার ঘোষণায় শেখ মুজিবুর রহমানের পাশাপাশি স্থান পেয়েছেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মেজর জিয়াউর রহমান। তথ্যের পাশাপাশি পাঠ্যবইয়ে তার ছবিও যুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া খালেদা জিয়া, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও জাতীয় চার নেতার তথ্য এবং ছবি যুক্ত হয়েছে পাঠ্যবইয়ে। শ্রেণিভেদে অনেক তথ্য-উপাত্ত যোগ করা হয়েছে, আগের মতোই রাখা হয়েছে কিংবা বাদ দেওয়া হয়েছে।

শিক্ষাবিদরা বলেন, যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসেছে, পাঠ্যবইয়ে সেই রাজনৈতিক দলের গুণগান করা হয়েছে। গত সাড়ে ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমানের একক কৃতিত্ব ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল। একেবারেই মুছে ফেলা হয়েছিল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নাম। এ ছাড়া দেশের স্বাধীনতার পেছনে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নেতা তাজউদ্দীন আহমদসহ অনেকের অবদান মুছে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানীর অবদানকেও খাটো করা হয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকার নতুন পাঠ্যবইয়ে জাতীয় সব বীরের অবদানই তুলে ধরেছে। সামনে যারাই ক্ষমতায় আসবে, তারাও যেন একইভাবে সবার অবদানকে স্বীকার করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন ও বিভিন্ন শ্রেণির ইতিহাস বিষয়ক বইগুলোর পর্যালোচক (রিভিউয়ার) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান কালবেলাকে বলেন, ইতিহাসকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দিতে হয়। বিগত সময়ে সরকার ইতিহাসকে বিকৃত করেছে। একজনকে মহামানব বানাতে গিয়ে অন্যদের ভুলভাবে উপস্থাপন করেছে কিংবা তাদের কোনো অবদানই স্বীকার করেনি। সে কারণে এই বছরের পাঠ্যবইয়ে ইতিহাসের মূল তথ্যগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে সময় ছিল কম। আশা করি, সামনের বছরগুলোতে এটি বিস্তৃত আকারে উঠে আসবে। এটাই পরিমার্জন সংশ্লিষ্টদের কাজ হওয়া উচিত।

ইতিহাসের পাঠে এসেছে যেসব পরিবর্তন

চতুর্থ শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ পাঠ্যবইয়ে স্বাধীনতার ঘোষণার বিষয়টি রয়েছে। নতুন বইয়ে এই অধ্যায়ের ‘১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক লেখায় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ছবির পাশাপাশি মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার ছবি স্থান পেয়েছে, যা আগে ছিল না। জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে অন্য বইগুলোতেও। পঞ্চম শ্রেণির একই বইয়ে ‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক অধ্যায়ের শুরুতে রয়েছে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ছবি। পাশে রয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি। জাতীয় চার নেতার ছবিও রয়েছে। পুরোনো বইয়ে একই স্থানে শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় চার নেতার ছবি ছিল।

একই বইয়ে মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে ভাসানীর নাম যুক্ত হয়েছে। দেশের মানুষের প্রিয় গানের তালিকায় ছিল শুধুমাত্র ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’। এটির পাশাপাশি ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’, ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’ গান দুটি যুক্ত করা হয়েছে। আগের বইয়ে বুদ্ধিজীবীদের নাম উল্লেখ ছিল না, এই বইয়ে তা যুক্ত করা হয়েছে। নতুন বইয়ে পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের সময় মুক্তিবাহিনীর উপপ্রধান সেনাপতি গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারের নামও উল্লেখ করা হয়েছে। এই শ্রেণির বাংলা বইয়ে নতুন যুক্ত হওয়া আমরা তোমাদের ভুলব না অধ্যায়ে আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে শহীদ মীর নিসার আলী তিতুমীর থেকে শুরু করে এ বছরের জুলাই গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে শহীদদের স্মরণ করা হয়েছে।

নবম-দশম শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি মিছিল ও পিকেটিং করার সময় শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যদের গ্রেপ্তারের বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা অংশে সবকিছু আগের মতো থাকলেও একটি লাইন বাদ দেওয়া হয়েছে। সেটি হলো, ভারতের বহু সৈন্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ হারান।

বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা বইয়ে ‘ছয় দফা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ পাঠকে লেখা হয়েছে ‘আওয়ামী লীগের ছয় দফা’। শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধি প্রদান পাঠটি বাদ দেওয়া হয়েছে। তবে সত্তরের নির্বাচন এবং মুক্তিযুদ্ধ অধ্যায়ে নির্বাচনোত্তর নেতাকর্মী বেষ্টিত তার ছবি ঠিক রাখা হয়েছে। আবার মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানের সহযোগী রাজাকারের বিষয়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তবে কোনো রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তির নাম ব্যবহার করা হয়নি, যা আগের বইয়ে উল্লেখ ছিল।

আ.লীগকে ‘বড় দল’ ঘোষণায় সমালোচনা

এদিকে, নবম-দশম শ্রেণির পৌরনীতি ও নাগরিকতা বইয়ের ‘গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন ব্যবস্থা’ অধ্যায়ে আওয়ামী লীগের পরিচয় তুলে ধরে বলা হয়েছে, ‘আওয়ামী লীগ এ দেশের সবচেয়ে পুরাতন ও বৃহত্তম রাজনৈতিক দল।’ পুরোনো বইয়ে দলটি সম্পর্কে আরও বিস্তারিত তথ্য থাকলেও তা ছেঁটে ফেলা হয়েছে। তবে পুরাতন ও বৃহত্তম দল বাক্যটি রাখা হয়েছে।

বিএনপি সম্পর্কে বইয়ে লেখা হয়েছে, ‘সাবেক সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনামলে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠিত হয়।’ বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ছাপা বইয়েও বিএনপি সম্পর্কে একই তথ্য ছিল। তবে পুরোনো বইয়ে থাকা একটি অংশ এবার বাদ দেওয়া হয়েছে। তা হলো ‘বিভিন্ন দল ও আদর্শের নেতাকর্মীদের একত্রিত করে গঠিত।’

বিএনপির শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক ও বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ বি এম ওবায়দুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, আওয়ামী লীগ অনেক পুরোনো দল। কিন্তু তাদের দলের নেতা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। তারা এখন বৃহত্তম দল আছে কি না, তাদের অবস্থান কোথায়, সেটি জনগণই বিবেচনা করবে। জনগণই বলছে, বিএনপি এখন বৃহত্তম দল। বিএনপি বিষয়ে তিনি বলেন, বিএনপি ক্যান্টনমেন্টে গড়ে ওঠেনি। মানুষের চাহিদার কারণেই শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এই দলটি গঠন করেছেন। মানুষ চেয়েছে বলেই প্রয়োজনীয়তার খাতিরে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন।

এদিকে, নবম-দশমের পৌরনীতি ও নাগরিকতা বইয়ের পুরোনো সংস্করণে জাতীয় পার্টিকে দেশের তৃতীয় বৃহৎ দল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। তবে এবার সেই ‘তকমা’ বাদ দেওয়া হয়েছে। সঙ্গে দলের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নামের আগে ‘সামরিক শাসক’ শব্দটি যুক্ত হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ছাপা বইয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে ভর্ৎসনা ছিল। নতুন পাঠ্যবইয়ে তা বাদ দেওয়া হয়েছে। তবে ‘বিতর্কিত ভূমিকা’র কথা তুলে ধরে বলা হয়েছে—বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দলটি পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার পক্ষে কাজ করেছে।

আওয়ামী লীগ আমলে একই বইয়ে সাতটি রাজনৈতিক দলের পরিচয় ও বর্ণনা স্থান পেলেও এবার বাদ পড়েছে রাশেদ খান মেননের বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি।

জানতে চাইলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, ‘দ্রুত কাজ করতে গিয়ে ত্রুটিবিচ্যুতি থেকে যেতে পারে। বিষয়টি আমরা আবারও রিভিউ করে দেখব। আলোচনা করে প্রয়োজনে সংশোধনী দেব।’

ট্যাগ

আওয়ামী লীগকে ‘বড় দল’ ঘোষণায় সমালোচনা

আপডেট সময়ঃ ০১:৪৭:৩৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ১১ জানুয়ারী ২০২৫

চলতি শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবইয়ে দেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের পাঠে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। আওয়ামী লীগ আমলের একপক্ষীয় ইতিহাস বাদ দেওয়া হয়েছে। বাদ পড়েছে অতিরঞ্জন ও অতিবন্দনা। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ, যার যেটুকু অবদান, সেটিই তুলে ধরা হয়েছে। অবদানের স্বীকৃতির কারণে এবার স্বাধীনতার ঘোষণায় শেখ মুজিবুর রহমানের পাশাপাশি স্থান পেয়েছেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মেজর জিয়াউর রহমান। তথ্যের পাশাপাশি পাঠ্যবইয়ে তার ছবিও যুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া খালেদা জিয়া, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও জাতীয় চার নেতার তথ্য এবং ছবি যুক্ত হয়েছে পাঠ্যবইয়ে। শ্রেণিভেদে অনেক তথ্য-উপাত্ত যোগ করা হয়েছে, আগের মতোই রাখা হয়েছে কিংবা বাদ দেওয়া হয়েছে।

শিক্ষাবিদরা বলেন, যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসেছে, পাঠ্যবইয়ে সেই রাজনৈতিক দলের গুণগান করা হয়েছে। গত সাড়ে ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমানের একক কৃতিত্ব ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল। একেবারেই মুছে ফেলা হয়েছিল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নাম। এ ছাড়া দেশের স্বাধীনতার পেছনে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নেতা তাজউদ্দীন আহমদসহ অনেকের অবদান মুছে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানীর অবদানকেও খাটো করা হয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকার নতুন পাঠ্যবইয়ে জাতীয় সব বীরের অবদানই তুলে ধরেছে। সামনে যারাই ক্ষমতায় আসবে, তারাও যেন একইভাবে সবার অবদানকে স্বীকার করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন ও বিভিন্ন শ্রেণির ইতিহাস বিষয়ক বইগুলোর পর্যালোচক (রিভিউয়ার) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান কালবেলাকে বলেন, ইতিহাসকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দিতে হয়। বিগত সময়ে সরকার ইতিহাসকে বিকৃত করেছে। একজনকে মহামানব বানাতে গিয়ে অন্যদের ভুলভাবে উপস্থাপন করেছে কিংবা তাদের কোনো অবদানই স্বীকার করেনি। সে কারণে এই বছরের পাঠ্যবইয়ে ইতিহাসের মূল তথ্যগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে সময় ছিল কম। আশা করি, সামনের বছরগুলোতে এটি বিস্তৃত আকারে উঠে আসবে। এটাই পরিমার্জন সংশ্লিষ্টদের কাজ হওয়া উচিত।

ইতিহাসের পাঠে এসেছে যেসব পরিবর্তন

চতুর্থ শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ পাঠ্যবইয়ে স্বাধীনতার ঘোষণার বিষয়টি রয়েছে। নতুন বইয়ে এই অধ্যায়ের ‘১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক লেখায় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ছবির পাশাপাশি মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার ছবি স্থান পেয়েছে, যা আগে ছিল না। জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে অন্য বইগুলোতেও। পঞ্চম শ্রেণির একই বইয়ে ‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক অধ্যায়ের শুরুতে রয়েছে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ছবি। পাশে রয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি। জাতীয় চার নেতার ছবিও রয়েছে। পুরোনো বইয়ে একই স্থানে শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় চার নেতার ছবি ছিল।

একই বইয়ে মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে ভাসানীর নাম যুক্ত হয়েছে। দেশের মানুষের প্রিয় গানের তালিকায় ছিল শুধুমাত্র ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’। এটির পাশাপাশি ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’, ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’ গান দুটি যুক্ত করা হয়েছে। আগের বইয়ে বুদ্ধিজীবীদের নাম উল্লেখ ছিল না, এই বইয়ে তা যুক্ত করা হয়েছে। নতুন বইয়ে পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের সময় মুক্তিবাহিনীর উপপ্রধান সেনাপতি গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারের নামও উল্লেখ করা হয়েছে। এই শ্রেণির বাংলা বইয়ে নতুন যুক্ত হওয়া আমরা তোমাদের ভুলব না অধ্যায়ে আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে শহীদ মীর নিসার আলী তিতুমীর থেকে শুরু করে এ বছরের জুলাই গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে শহীদদের স্মরণ করা হয়েছে।

নবম-দশম শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি মিছিল ও পিকেটিং করার সময় শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যদের গ্রেপ্তারের বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা অংশে সবকিছু আগের মতো থাকলেও একটি লাইন বাদ দেওয়া হয়েছে। সেটি হলো, ভারতের বহু সৈন্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ হারান।

বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা বইয়ে ‘ছয় দফা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ পাঠকে লেখা হয়েছে ‘আওয়ামী লীগের ছয় দফা’। শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধি প্রদান পাঠটি বাদ দেওয়া হয়েছে। তবে সত্তরের নির্বাচন এবং মুক্তিযুদ্ধ অধ্যায়ে নির্বাচনোত্তর নেতাকর্মী বেষ্টিত তার ছবি ঠিক রাখা হয়েছে। আবার মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানের সহযোগী রাজাকারের বিষয়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তবে কোনো রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তির নাম ব্যবহার করা হয়নি, যা আগের বইয়ে উল্লেখ ছিল।

আ.লীগকে ‘বড় দল’ ঘোষণায় সমালোচনা

এদিকে, নবম-দশম শ্রেণির পৌরনীতি ও নাগরিকতা বইয়ের ‘গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন ব্যবস্থা’ অধ্যায়ে আওয়ামী লীগের পরিচয় তুলে ধরে বলা হয়েছে, ‘আওয়ামী লীগ এ দেশের সবচেয়ে পুরাতন ও বৃহত্তম রাজনৈতিক দল।’ পুরোনো বইয়ে দলটি সম্পর্কে আরও বিস্তারিত তথ্য থাকলেও তা ছেঁটে ফেলা হয়েছে। তবে পুরাতন ও বৃহত্তম দল বাক্যটি রাখা হয়েছে।

বিএনপি সম্পর্কে বইয়ে লেখা হয়েছে, ‘সাবেক সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনামলে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠিত হয়।’ বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ছাপা বইয়েও বিএনপি সম্পর্কে একই তথ্য ছিল। তবে পুরোনো বইয়ে থাকা একটি অংশ এবার বাদ দেওয়া হয়েছে। তা হলো ‘বিভিন্ন দল ও আদর্শের নেতাকর্মীদের একত্রিত করে গঠিত।’

বিএনপির শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক ও বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ বি এম ওবায়দুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, আওয়ামী লীগ অনেক পুরোনো দল। কিন্তু তাদের দলের নেতা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। তারা এখন বৃহত্তম দল আছে কি না, তাদের অবস্থান কোথায়, সেটি জনগণই বিবেচনা করবে। জনগণই বলছে, বিএনপি এখন বৃহত্তম দল। বিএনপি বিষয়ে তিনি বলেন, বিএনপি ক্যান্টনমেন্টে গড়ে ওঠেনি। মানুষের চাহিদার কারণেই শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এই দলটি গঠন করেছেন। মানুষ চেয়েছে বলেই প্রয়োজনীয়তার খাতিরে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন।

এদিকে, নবম-দশমের পৌরনীতি ও নাগরিকতা বইয়ের পুরোনো সংস্করণে জাতীয় পার্টিকে দেশের তৃতীয় বৃহৎ দল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। তবে এবার সেই ‘তকমা’ বাদ দেওয়া হয়েছে। সঙ্গে দলের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নামের আগে ‘সামরিক শাসক’ শব্দটি যুক্ত হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ছাপা বইয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে ভর্ৎসনা ছিল। নতুন পাঠ্যবইয়ে তা বাদ দেওয়া হয়েছে। তবে ‘বিতর্কিত ভূমিকা’র কথা তুলে ধরে বলা হয়েছে—বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দলটি পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার পক্ষে কাজ করেছে।

আওয়ামী লীগ আমলে একই বইয়ে সাতটি রাজনৈতিক দলের পরিচয় ও বর্ণনা স্থান পেলেও এবার বাদ পড়েছে রাশেদ খান মেননের বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি।

জানতে চাইলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, ‘দ্রুত কাজ করতে গিয়ে ত্রুটিবিচ্যুতি থেকে যেতে পারে। বিষয়টি আমরা আবারও রিভিউ করে দেখব। আলোচনা করে প্রয়োজনে সংশোধনী দেব।’