
পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি উপজেলার কৌরিখাড়া এলাকার মজনু মিয়া দুই যুগ পূর্বে বিসিক শিল্প নগরীর রশির কারখানায় কাজ করতে গিয়ে পায়ে আঘাত পান। আঘাতের ক্ষত থেকে তার পায়ে গ্যাংগ্রিন রোগের সৃষ্টি হয়। সেই রোগের কারণে তার দুই পা কোমর পর্যন্ত কেটে ফেলতে হয়েছে। কাটা পা নিয়ে মজনু ব্যবসাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
সাধারণত এমন অবস্থায় অনেকে অন্যের সাহায্যের আশায় বসে থাকেন। ব্যবসা করে স্বাবলম্বী হয়ে পরিবারের সদস্যদেরকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। পাশাপাশি তার কারখানায় বহুজনের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করেছেন। অদম্য মজনু মিয়ার সাফল্যগাঁথা জীবন সংগ্রাম নিয়ে লিখেছেন হযরত আলী হিরু।
শারীরিক অক্ষমতা জীবনের সক্ষমতাকে যে বাধাগ্রস্থ করতে পারে না সেটা দৃঢ় মনোবল ও কঠোর পরিশ্রম দিয়ে করে দেখিয়েছেন পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলার প্রতিবন্ধী মো. মজনু মিয়া। মারণব্যাধী গ্যাংগ্রিনে আক্রান্ত হয়ে দুটি পা হারিয়ে অর্ধশরীর নিয়ে ব্যবসায় শ্রম দিয়ে গেছেন। ফলশ্রুতিতে মজনু আজ স্বাবলম্বী পাশাপাশি তার মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে আরো কয়েকজনের।
পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলার সুটিয়াকাঠি ইউনিয়নের উত্তর কৌরিখাড়া এলাকার আব্দুল হাকিম মিয়ার বড় ছেলে মজনু মিয়া (৫১)।
টাকার অভাবে লেখাপড়া করা হয়নি তার। তাই তরুণ বয়সেই নেমে পড়েন কাজে। দুই যুগ পূর্বে ওই এলাকার বিসিক শিল্প নগরীতে সৈয়দ আশরাফুল হকের ক্রিফু ইন্টারন্যাশনাল রোপ ফ্যাক্টরিতে শ্রমিকের কাজ করতেন তিনি। কাজ করতে গিয়ে একদিন মজনুর ডান পায়ের আঙ্গুলে গুঁতো লাগে। পরবর্তীতে তা থেকে তার পায়ে গ্যাংগ্রিন হয়।
চিকিৎসকরা প্রথমে তার পায়ের ওই আক্রান্ত আঙ্গুলটিকে কেটে ফেলেন এবং পেটে একটা অপারেশন করেন। কিন্তু এতেও তার রোগ না সারলে একে একে তার পা চার বার কাটতে হয়। একপর্যায়ে তাকে বাঁচাতে তার দুটি পা কোমরের নিচে থেকে কেটে ফেলে চিকিৎসকরা। লম্বা সময়ের চিকিৎসার খরচ চালাতে গিয়ে মজনু ও তার পরিবার একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়েন। তখন মজনু মিয়ার শারীরিক অবস্থা দেখে তাকে আর কেউ কাজে নিতে চাইত না। এমতাবস্থায় জীবন ধারণের জন্য ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়া তার আর কোনো পথ ছিল না তার। কিন্তু মজনু মনে মনে ঠিক করলেন- ভিক্ষা নয় তিনি ব্যবসা করবেন। আর সে লক্ষে তিনি বেসরকারি এনজিও ব্র্যাক, আশা ও ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে একটি কারখানা খুললেন। তিনি তার কারখানায় কাঠের বাট, ক্রিকেট স্ট্যাম্প, খিল, দা কোদালের হাতল ইত্যাদি বানাতে শুরু করলেন। তার কারখানায় তৈরিকৃত এসব পণ্য ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহরে চালান দেন তিনি।
প্রথম দিকে তাকে কারখানায় এ কাজে তার মা রাবেয়া বেগম, স্ত্রী মিনারা বেগম ও ছোট ভাই মেহেদী হাসান সহযোগিতা করতেন। বর্তমানে তার কারখানায় পাঁচ জন শ্রমিক কাজ করেন। তাদের প্রত্যেকের বেতন ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা। মজনু মিয়া যান্ত্রিক হুইল চেয়ারে করে বিভিন্ন এলাকায় যাতায়াত করে তার ব্যবসায়ের কাজ চালাচ্ছেন। মজনু মিয়ার দুটি সন্তান বড় মেয়ে মরিয়ম আক্তার অনার্স চতুর্থ বর্ষে এবং ছেলে তামিম একাদশ শ্রেণিতে পড়ছে।
সন্তানের বেঁচে থাকা নিয়ে মজনু মিয়ার সত্তরোর্ধ্ব মা রাবেয়া বেগম বলেন, ‘মজনু আমার বড় সন্তান ওর চিকিৎসার খরচ চালিয়ে যেতে আমাদের অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। না খেয়েও কাটাতে হয়েছে বহু দিন। একটা সময় সবাই বলতেন ওকে বাঁচানো যাবে না। কিন্তু আমি মহান আল্লাহর কাছে চাচ্ছিলাম হে আল্লাহ আমার ছেলেটা বেঁচে থাকুক আমাকে মা বলে ডাকুক, আল্লাহ আমার ডাক শুনেছেন।’
ওই এলাকার ইউপি সদস্য খাজা ফরিদ বেপারী বলেন, ‘মজনু মিয়ার শারীরিক যে অবস্থা তাতে তার ভিক্ষা করা উচিত কিন্তু সে ব্যবসা করে। এটা সত্যিই আমাদের জন্য গর্বের।’
নিজের সম্পর্কে মজনু মিয়া বলেন, ‘আমি আল্লাহর কাছে বলেছি হে আল্লাহ আমাকে যেন কারো কাছে হাত পাততে না হয়। আপনি আমাকে রোজগার করে খাওয়ার তৌফিক দান করুন। বর্তমানে আমি আমার কারখানা থেকে যে টাকা উপার্জন করছি তাতে এনজিওর ঋণের কিস্তি দিয়ে কোনো রকমের সংসার চলে যাচ্ছে। আমার এই অক্ষমতা দেখে কেউ আমাকে বড় ঋণ দিতে চায় না। তবে সরকার যদি আমাকে পুঁজি বা সহজ শর্তে বিনাসুদে ঋণের ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে আমি আমার ব্যবসায়ের প্রসারতা বৃদ্ধি করে এখানে বহুজনের কর্মসংস্থানের সুযোগ দিতে পারব।’