জ্যেষ্ঠ নেতাদের খালেদা জিয়া বলেছেন, গণতন্ত্রই শেষ কথা
গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের কারণে রাজনৈতিক অঙ্গনে ও নেতাকর্মীদের কাছে ‘আপসহীন নেত্রী’র পরিচিতি পাওয়া বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আবারও গণতন্ত্রের কথাই বললেন। উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার প্রাক্কালে রাজনীতিতে চলার পথের দীর্ঘদিনের সারথিদের ডেকে তিনি বলেছেন, গণতন্ত্রই শেষ কথা। এ সময় দলের নীতিনির্ধারকদের বর্তমান প্রেক্ষাপটে ঐক্যবদ্ধ থেকে জনগণ ও গণতন্ত্রের পক্ষে কাজ করার নির্দেশনা দেন। বলেছেন ঐক্যের কথাও। বর্তমানে গণতন্ত্রের জন্য বিএনপির দ্রুত নির্বাচন দাবির সঙ্গেও একাত্মতা প্রকাশ করেন তিনি।
লন্ডন যাত্রার সব প্রস্তুতি শেষ হওয়ার মধ্যে রোববার রাতে রাজধানীর গুলশানের বাসভবন ‘ফিরোজা’য় দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সঙ্গে শুভেচ্ছা ও কুশল বিনিময় করেন খালেদা জিয়া।
লিভার সিরোসিসসহ নানা জটিলতায় আক্রান্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া যুক্তরাজ্যে গিয়ে ‘লন্ডন ক্লিনিক’-এ চিকিৎসা নেবেন। এ লক্ষ্যে আজ মঙ্গলবার রাত ১০টায় কাতারের আমিরের পাঠানো বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে লন্ডনের উদ্দেশে রওনা হওয়ার কথা রয়েছে বিএনপি চেয়ারপারসনের।
জানা গেছে, বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে খালেদা জিয়ার ‘আধা ঘণ্টার’ এই শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠান ছিল অনেকটাই আবেগনির্ভর। নানা প্রতিকূলতার পর দলীয় চেয়ারপারসন দেশের বাইরে চিকিৎসা করাতে যাচ্ছেন। খালেদা জিয়ার পাশাপাশি তার চিকিৎসার ইস্যুটিও নেতাকর্মীদের কাছে সব সময়ই আবেগের বিষয়। তবে ৫ আগস্টের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তিনি যে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে পারছেন, দলের নীতি-নির্ধারকরা ছাড়াও সারা দেশের নেতাকর্মীরা এ জন্য উদ্বেলিত। সাক্ষাতের সময় খালেদা জিয়ার জন্য তার দীর্ঘদিনের রাজনীতির সারথিরা দোয়া করেছেন, আশু সুস্থতা কামনা করেছেন। তবে সাক্ষাতের সময় তারা ছিলেন আবেগাপ্লুত। কেউ কেউ এতটাই আবেগপ্রবণ ছিলেন যে, চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। অবশ্য খালেদা জিয়া মানসিকভাবে দৃঢ় ছিলেন, মুখে হাসিও ছিল। জ্যেষ্ঠ নেতাদের তিনি এ সময় বলেন, ‘আপনারা ইমোশনাল হচ্ছেন কেন? আমার ওপর কত অত্যাচার-নির্যাতন হয়েছে, তারপরও আল্লাহ আমাকে কোথা থেকে ফেরত এনেছেন, আপনারা দেখেননি? আল্লাহর ওপর ভরসা রাখুন। আল্লাহই সুস্থতা দান করবেন, রক্ষা করবেন।’ নেতারাও আশা করছেন, তিনি আগামীতে সুস্থ হয়ে দেশে ফিরে গণতন্ত্রের পক্ষে নেতৃত্ব দেবেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য জানান, শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানে তারা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেও, খালেদা জিয়া স্বাভাবিকই ছিলেন। আবেগঘন পরিবেশের কারণে রাজনৈতিক আলোচনা তেমন হয়নি।
সাক্ষাৎ শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, ‘বেগম খালেদা জিয়া উন্নত চিকিৎসার জন্য ৭ জানুয়ারি রাতে লন্ডনের উদ্দেশে যাত্রা করবেন। সেই কারণে আমরা জাতীয় স্থায়ী কমিটির সকল সদস্য উনার কাছে এসেছিলাম শুভেচ্ছা জানাতে। আমরা তার সঙ্গে আলাপ করেছি, কথা বলেছি। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালার কাছে এই দোয়া করেছি– আল্লাহ তাকে সুস্থ করে আবার যেন আমাদের মাঝে, দেশের মানুষের মাঝে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন এবং গণতন্ত্রের জন্য আমাদের যে সংগ্রাম চলছে, সেই সংগ্রামে তিনি যেন নেতৃত্ব দিয়ে সংগ্রামকে সফল করতে পারেন। বাংলাদেশের মানুষেরও সেই প্রত্যাশা। দোয়া করছি, তার যাত্রা যেন সফল হয় এবং তিনি সুচিকিৎসা নিয়ে আবার ফিরে আসতে পারেন।’
খালেদা জিয়া কোনো নির্দেশনা কিংবা বার্তা দিয়েছেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ম্যাডাম নির্দেশনা দিয়েছেন, একসঙ্গে কাজ করো, জনগণের পক্ষে কাজ করো, গণতন্ত্রের পক্ষে কাজ করো।’
দলের স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘ম্যাডামকে মানসিক দিক দিয়ে একটু উৎফুল্লই দেখলাম। দেশে গণতন্ত্রের জন্য আমরা যে দ্রুত সময়ে নির্বাচনের দাবি করছি, এর সঙ্গে উনি একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। আমরাও দোয়া করেছি, উনি যেন সুস্থ হয়ে ফিরে এসে এই অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে পারেন।’
১৯৮১ সালের ৩০ মে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে হত্যার পর রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি যখন বিপর্যস্ত ও দিশেহারা, সেই পরিস্থিতিতে নেতাকর্মীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গৃহবধূ থেকে রাজনীতিতে আসেন জিয়াউর রহমানের সহধর্মিণী খালেদা জিয়া।
বিএনপির ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে খালেদা জিয়ার আত্মপ্রকাশ ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি। সেদিন তিনি বিএনপির প্রাথমিক সদস্যপদ নেন। এরপর ১৯৮৩ সালের মার্চে তিনি দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হন। এর কয়েক মাস পরেই খালেদা জিয়া দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন। এ সময় এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। এরপর ১৯৮৪ সালের ১০ মে খালেদা জিয়া বিএনপির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় কয়েকবার আটক হলেও গণতন্ত্রের আন্দোলন থেকে সরেননি তিনি। আশির দশকে জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মাধ্যমে দেশজুড়ে খালেদা জিয়ার ব্যাপক পরিচিত গড়ে উঠে। রাজনীতিতে আসার ১০ বছরের মধ্যেই ১৯৯১ সালে প্রধানমন্ত্রী হন খালেদা জিয়া। পরে আরও দুই দফায় প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন তিনি।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাগারে যান খালেদা জিয়া। তবে বিএনপির দাবি ছিল, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যা মামলায় তাকে অন্যায়ভাবে সাজা দেওয়া হয়েছে। দলটির আরও দাবি, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ‘ভোটারবিহীন’ নির্বাচনের পর ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম’ অব্যাহত রাখায় তৎকালীন আওয়ামী সরকারের রোষানলে পড়েন খালেদা জিয়া। ২০২০ সালের মার্চে তৎকালীন সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে সাময়িক মুক্তি পান বিএনপি চেয়ারপারসন। তবে এর মধ্যে চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশ যাওয়ার সুযোগ দিতে পরিবারের পক্ষ থেকে কয়েকদফায় আবেদন করা হলেও তা প্রত্যাখ্যাত হয়। এরপর ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতির আদেশে স্থায়ী মুক্তি পান তিনি।
খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন লন্ডনে অবস্থানরত তার বড় ছেলে তারেক রহমান। সেই থেকে লন্ডনে অবস্থান করেই দল পরিচালনা করছেন তিনি। মাঝে খালেদা জিয়া সাময়িক মুক্তি পেলেও দীর্ঘ অসুস্থতা ও আইনি বাধ্যবাধকতায় রাজনীতির বাইরেই ছিলেন। এ কারণে দল পরিচালনায় তেমন সিদ্ধান্ত দিতেন না।
বিএনপি নেতাদের দাবি, তারেক রহমানের নেতৃত্বে দল ঐক্যবদ্ধ ও সুসংগঠিত। দায়িত্ব নিয়ে সারা দেশে সংগঠন পুনর্গঠন করে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে লন্ডন থেকে নেতৃত্ব দেন তিনি। জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনেও তারেক রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।