হাবিবুর রহমান হাবিব
সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টারঃ
৭১-এর রণাঙ্গণের বীর সৈনিক মাহমুদ উল্লাহ দুলু। বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধ অংশ নিয়ে দেশ স্বাধীন করেন। মুক্তিযোদ্ধার সনদপত্রসহ সব কিছুই ঠিক রয়েছে তাঁর। এরপরও দীর্ঘ ৯ বছর ধরে ভাতা পাচ্ছেন না। ফলে স্বাধীনতার জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করা এই সূর্য সন্তানের পরিবারে নেমে এসেছে ভয়াবহ বিপর্যয়। এমনকি মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও নেই। অন্যের বাড়িতে আশ্রিতা হয়ে অনাহারে-অর্ধহারে দিন কাটছে তাদের। পাশাপাশি অর্থের অভাবে এক ছেলের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। বাকি দুইজনেরও বন্ধ হওয়ার উপক্রম। এমন পরিস্থিতে চোখে অন্ধকার দেখছেন ৭৮বছর বয়সী এই মুক্তিযোদ্ধা।
যশোর জেলার চৌগাছা উপজেলার ইছাপুর গ্রামে জন্ম মাহমুদ উল্লাহ দুলুর। বাবার নাম গোলাম রব্বানী। বর্তমানে তিনি বগুড়া শেরপুর উপজেলার শাহবন্দেগী ইউনিয়নের সাধুবাড়ী গ্রামে থাকেন। প্রায় দুই যুগ ধরে ওই গ্রামের শিক্ষক আব্দুল কাদের মজনুর বাড়িতে পাঁচ সদস্যের পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন। স্ত্রী শাহানাজ পারভীন একজন গৃহিনী। বড় ছেলে শাহজাদ ফেরদৌস দশম শ্রেণীর ছাত্র। অর্থের অভাবে লেখাপড়া বন্ধ রেখে বর্তমানে শহরের একটি কাপড়ের দোকানে চাকরি নিয়েছেন। বাকি দুই ছেলের মধ্যে শাহজাদ সাফ্ফাত নবম শ্রেণী ও শাহজাদ বারাকাত স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণীতে পড়ে।
রবিবার (০৪জুন) একান্ত আলাপচারিতায় মাহমুদ উল্লাহ দুলু বলেন, ১৯৭১সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নয় নম্বর সেক্টরের সুন্দরবন সাব সেক্টরে যুদ্ধ করেন। মুক্তিবার্তা নম্বর-০৪০৫০৭০২৩৭। দেশ স্বাধীনের পর বাংলাদেশ টেলিভিশনে চাকরির মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু হয়। এছাড়াও বিগত ১৯৮৯সাল পর্যন্ত বিভিন্ন দেশি-বিদেশী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। বেশ সুনামের সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠাতে চাকরি করেছেন। পরবর্তীতে কর্মহীন হয়ে পড়েন। তবে মুক্তিযোদ্ধার ভাতার টাকায় পরিবার-পরিজন নিয়ে কোনো রকমে দিনাতিপাত করছিলেন তিনি। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে বিগত ২০১৪সাল থেকে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা বন্ধ করে দেওয়া হয়। অথচ পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়েও সাধারণ ‘ক’ শ্রেণীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত। প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও ভাতা চালুর বিষয়ে কোনো প্রতিকার পাচ্ছেননা। ভাতা না পাওয়ায় সংসারে অভাব দেখা দিয়েছে। এমনকি পরিবার-পরিজন নিয়ে চরম মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। এমন অবস্থায় বীরপ্রতীক আনোয়ার হোসেন ও আ.লীগ নেতা মোজাফফর হোসেন পল্টুর দেওয়া আর্থিক সহযোগিতায় কোনো রকমে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন তাদের পরিবারের সদস্যরা।
জনাব মাহমুদ উল্লাহ দুলু আরও বলেন, বিগত ০৫মে ভাতা বন্ধের বিষয়ে খোঁজখবর নিতে যশোরের চৌগাছায় যান। এরপর জানতে পারেন তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত কাল্পনিক ঘটনার কথা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কোনো এক মুক্তিযোদ্ধা নাকি অভিযোগ করেছেন, আলিমুজ্জামান নামের ভাতা নিচ্ছি। অথচ ওই নামের কোনো ব্যক্তি তার সেক্টরে যুদ্ধই করেনি। এমনকি চৌগাছা উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় আলিমুজ্জামান নামের কোনো ব্যক্তির নাম নেই। এরপরও ভিত্তিহীন অভিযোগে দীর্ঘদিন ধরে তাঁর মুক্তিযোদ্ধা ভাতা বন্ধ করে রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহমুদ উল্লাহ দুলুর স্ত্রী শাহনাজ পারভীন বলেন, তিনি দেশ স্বাধীনের জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন। তাই বয়সের ব্যবধান থাকলেও নিজের ইচ্ছায় তাঁকে বিয়ে করেছিলাম। বিয়ের পর ভালোই চলছিল তাদের সংসার। আয়-রোজগারও ভালোই ছিল। এরইমধ্যে একে একে তিন সন্তানের জন্ম হয়। তাদের পড়াশোনার জন্য স্কুলে ভর্তি করে দেই। কিন্তু আমার স্বামীর মুক্তিযোদ্ধা ভাতা বন্ধ হওয়ার পর থেকে দুর্বিষহ জীবন শুরু হয়। অর্থের অভাবে বড় ছেলের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। বাকি দুই ছেলের পড়াশোনাও বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এমন পরিস্থিতে পরিবারের সদস্যদের মুখে দু’মুঠো ভাত তুলে দিতে বড় ছেলে তিন হাজার টাকায় মাসিক বেতনে চাকরি নিয়েছে। নিজস্ব কোনো জায়গা জমিও নেই। অন্যের বাড়িতে এক হাজার দুইশ’ টাকায় ভাড়া থাকেন। তাই ছেলের বেতনের প্রায় অর্ধেক টাকা চলে যায় বাসা ভাড়া দিতেই। পরিবারের একমাত্র উপর্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা স্বামী। কিন্তু তিনি বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। নানা রোগ বাসা বেঁধেছে তার শরীরে। অর্থের অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না। এমনকি ঔষুধও কিনতে পারছেন না। এছাড়া বাজারে সব জিনিসের দাম ঊর্ধ্বমুখি। তাই এখন সংসার চালানোই দায়। ছেলের সামান্য বেতনের টাকায় এখন কী আর সংসার চালানো সম্ভব?। তাই প্রতিদিন এক বেলা রান্না হলে অন্য বেলায় পরিবারের সবাইকে উপোস থাকতে হয়। সেটি কাউকে বুঝতেও দেই না, বলিও না। কারণ অন্যদের বলে আর লাভ কী। দেখার তো কেউ নেই। এমন পরিস্থিতে জরুরি ভিত্তিতে স্বামীর মুক্তিযোদ্ধার ভাতা চালু না হলে সবাইকে অনাহারে থেকেই মারা যেতে হবে বলে মন্তব্য করেন। প্রতিবেশি আব্দুল কাদের, আব্দুস সাত্তার ছামেদ বলেন, তিনি একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু কেন যে তার ভাতা বন্ধ রয়েছে আমরা সেটি বলতে পারবো না। তবে দীর্ঘদিন ধরে পরিবার-পরিজন নিয়ে খুবই কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। তাই সরকারের জনকল্যাণ মূলক তহবিল থেকে মানবিক কারণে নিয়মিত আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শেরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সানজিদা সুলতানা বলেন, বিষয়টি তার জানা নেই। তাই খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় সাহায্য সহযোগিতার আশ্বাস দেন তিনি।