শুধু ‘কমলা’ নামেই ভুবন বিখ্যাত। পুরো নাম কমলা দেবী হ্যারিস। জন্ম ১৯৬৪ সালের ২০ অক্টোবর। জন্মেছেন ক্যালিফোর্নিয়ার ওকল্যান্ড শহরে। রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী। ২০০ বছরের মার্কিন ইতিহাসের প্রথম নারী (ভাইস প্রেসিডেন্ট) উপরাষ্ট্রপতি হয়ে আগেই সৃষ্টি করেছিলেন ইতিহাস। এবার গড়লেন অনন্য উদাহরণ। তিনি এবার হলেন মার্কিন ইতিহাসের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট। যদিও ক্ষমতার সময়সীমা ছিল মাত্র ৮৫ মিনিট।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার অংশ হিসাবে কোলোনোস্কপি পরীক্ষা করা হয়। ঠিক ওই সময়ের জন্য মার্কিন প্রেসিডেনশিয়াল ক্ষমতা দেওয়া হয় ৫৭ বছর বয়সি কমলাকে। বাইডেনের কোলোনোস্কপির সময় তাকে অবচেতন করা হয়। ওই সময়টুকুর জন্য তিনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কমলার কাছে হস্তান্তর করেন। চিকিৎসা শেষে বাইডেনের চিকিৎসক কেভিন ও’কনর জানান, তার স্বাস্থ্যের অবস্থা এখন ঠিকঠাক। তিনি এখন নিয়মিত দায়িত্ব পালনের জন্য শারীরিকভাবে প্রস্তুত।
বাইডেনের ৭৯তম জন্মবার্ষিকীর ঠিক আগের দিন তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। অবশ্য কমলা হ্যারিস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি প্রেসিডেন্ট কার্যালয় ব্যবহার করেননি। নিজ কার্যালয় হোয়াইট হাউজের ওয়েস্ট উইং থেকেই প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেছেন। ঐতিহাসিক ৮৫ মিনিটের দায়িত্বে তিনি কী কী কাজ করেছেন, তা জানানো হয়নি।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসাবে কমলা হ্যারিসের দায়িত্ব প্রসঙ্গে হোয়াইট হাউজের প্রেস সেক্রেটারি জেন সাকি জানালেন, মাত্র ৮৫ মিনিটের জন্য কমলা যে দায়িত্ব পেয়েছিলেন, তা মোটেও অবিশ্বাস্য ঘটনা নয়। মার্কিন সংবিধানে এ ধরনের সুযোগ আছে। আর নিয়মিত কার্যপ্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে এমনটা করা হয়ে থাকে। ২০০২ ও ২০০৭ সালে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের আমলে এমন ক্ষমতা হস্তান্তরের ঘটনা ঘটে। তবে নারী প্রেসিডেন্ট হিসাবে এটাই প্রথম ঘটনা। যা ইতিহাস সৃষ্টি করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে কমলার আগে মাত্র দু’জন নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হয়েছিলেন। ২০০৮ সালে রিপাবলিকান দল থেকে সারাহ পলিন। ১৯৮৪ সালে ডেমোক্র্যাটিক দল থেকে জেরালডিন ফেরারো। কমলা ডেমোক্র্যাটিক দলের জনপ্রিয় নারী সদস্য। ২০২০ সালে অনুষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী জো বাইডেনের সঙ্গে অংশ নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং উপরাষ্ট্রপতি মাইক পেন্সকে করেছেন ধরাশায়ী। ২০২১ সালের ২০ জানুয়ারি তিনি যুক্তরাষ্ট্রের উপরাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথগ্রহণ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের কনিষ্ঠতম সিনেটর হিসাবে ২০১৭ সাল থেকে ক্যালিফোর্নিয়ার দায়িত্ব পালন করছিলেন। কমলা মার্কিন ইতিহাসে প্রথম এশীয়, কৃষ্ণাঙ্গ ও নারী যিনি যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদে জয়ী হয়েছেন। উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার আগে তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার সিনেটর ছিলেন।
বাবা কৃষ্ণাঙ্গ। জ্যামাইকান নাগরিক। মা ভারতীয়। মা শ্যামলা গোপালন পেশায় জীববিজ্ঞানী। তিনি ব্রেস্ট ক্যানসার গবেষণায় প্রজেস্টেরন রিসেপ্টর জিন উদ্দীপিত নিয়ে কাজ করেছেন। ১৯৫৮ সালে ১৯ বছর বয়সে তার মা ভারতের তামিলনাড়ু থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছিলেন। তখন তিনি পুষ্টি এবং অ্যান্ডোক্রিনোলজি বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলে থেকে ১৯৬৪ সালে পিএইচডি ডিগ্রি করেন শ্যামলা। বাবা ডোনাল্ড জে হ্যারিস হলেন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ইমেরিটাস। ১৯৬১ সালে ব্রিটিশ জামাইকা থেকে বার্কলে আসেন স্নাতক করতে। ১৯৬৬ সালে অর্থনীতিতে পিএইচডি সম্পন্ন করেন। পরিবারে আছে ছোট বোন মায়া। বার্কলেতে অবস্থিত ‘ফ্ল্যাটল্যান্ডস’ অঞ্চলে বসবাস করতেন। মূলত যে অঞ্চল কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীদের জায়গা বলে পরিচিত। পরে কমলা ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল নিযুক্ত হন। তারপর হন ক্যালিফোর্নিয়ার সিনেটর। তিনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় কৃষ্ণাঙ্গ নারী সিনেটর। হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, হেস্টিংস কলেজ অব ‘ল’ থেকে স্নাতক করেন। কর্মজীবনের সূচনা আল্যামেডা কাউন্টি জেলার অ্যাটর্নি অফিসে। পরে সান ফ্রান্সিসকো অ্যাটর্নি অফিসে। তারপর সিটি অ্যাটর্নি অব ফ্রান্সিসকো অফিসে নিযুক্ত হন। ২০০৩ সালে তিনি সান ফ্রান্সিসকোর অ্যাটর্নি জেনারেল নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালেও পুনঃনির্বাচিত হন।
সিনেটর হয়েই তিনি স্বাস্থ্যসেবা সংস্কার, নিয়ন্ত্রিত পদার্থের তফসিল থেকে গাঁজা বাতিলকরণ, অনিবন্ধিত অভিবাসীদের নাগরিকত্বের পথ হিসাবে ড্রিম আইন, আগ্নেয়াস্ত্র নিষিদ্ধকরণ এবং প্রগতিশীল কর সংস্কারকে সমর্থন করেছিলেন। যা তার জনপ্রিয়তার পেছনে অন্যতম কারণ। সিনেটের শুনানির সময় ট্রাম্প প্রশাসন কর্তাদের প্রতি দূরদর্শী প্রশ্নের বদৌলতে তিনি বহির্বিশ্বে রাতারাতি খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন। কৃষ্ণাঙ্গ বলে সমাজের নানাবিধ বৈপরীত্যের মধ্যে বেড়ে উঠেছেন। দেখেছেন মা-বাবার বিচ্ছেদ। কৃষ্ণাঙ্গ বলে সমাজের কাছে হয়েছেন অবহেলিত আর অধিকার বঞ্চিত। তাই নিজেকে দায়িত্ববান করার স্বপ্ন বুনতেন।
মার্কিন ইতিহাসে প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়ে বলেছিলেন, আমিই শেষ নই। আজকের কন্যাশিশুরা দেখছে নারীদের জন্য এটি একটি অপার সম্ভাবনা। স্বপ্ন দেখ। নিজেকে এমনভাবে তৈরি কর যা কেউ আগে কখনো দেখেনি বা করেনি। জীবনে জয়ী হতে অদম্য লড়াই করতেই হয়। আমিই যার দৃশ্যত প্রমাণ। এভাবেই নিজের সাফল্যের কথা সবার উদ্দেশে বলেছেন কমলা হ্যারিস।