বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পর্যটকের সংখ্যা ১০০ কোটিরও বেশি। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৫ সাল নাগাদ এ সংখ্যা দাঁড়াবে ১৬০ কোটি। পর্যটন বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বিপুলসংখ্যক পর্যটকের প্রায় ৭৩ শতাংশ ভ্রমণ করবেন এশিয়ার দেশগুলোতে। বাংলাদেশ যদি এ বিশাল বাজার ধরতে পারে তাহলে পর্যটনের হাত ধরেই বদলে যেতে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতি। কিন্তু ৯ বাধার কারণে পর্যটনবান্ধব হতে পারছে না বাংলাদেশ। এ জন্য নানা উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছে।
পর্যটন শিল্পের জিডিপিতে প্রত্যক্ষ অবদানের ভিত্তিতে ১৭৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের অবস্থান ১৪২তম। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে দেয়া এক প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনটি দিয়েছে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন। যে ৯টি বাধার কথা উল্লেখ করা হয়েছে এর মধ্যে রয়েছে- প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বাইরে পর্যটন উপযোগী উল্লেখযোগ্য ও উপযোগী উপাদানের অভাব। এই খাতে সরকারের বাজেট বরাদ্দের অপ্রতুলতা, সড়ক, নদীপথ, রেল ও বিমান যোগাযোগের নিরাপদ ও উপযুক্ত মানের পর্যটন উপযোগী পরিকল্পিত ও সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থাপনার অনুপযোগিতা ও অপর্যাপ্ততা, পর্যটন দৃষ্টিকোণে সঠিক বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীতকরণে উপযুক্ত প্রচারণার অভাব, পর্যটন খাতকে সমৃদ্ধকরণে দেশের গণমাধ্যমের (প্রিন্ট, ইলেক্ট্রনিক্স ও ইন্টারনেটভিত্তিক সংবাদমাধ্যম) আন্তরিক সংশ্লিষ্টতা ও যথাযথ উদ্যোগের অভাব, আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতা ও কার্যকরী সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রিতা, পর্যটন শিল্প খাতটির সঠিক উপলব্ধি, মানসিকতা ও ধারণার অভাব, পর্যটন খাতে নিযুক্ত জনবলের মানসিকতা, পর্যাপ্ত জ্ঞান ও পেশাদারিত্বের অভাব। সেই সঙ্গে পর্যটন বিষয়ক সঠিক, উপযুক্ত শিক্ষিত ও মননের মানুষের অপর্যাপ্ততা, প্রান্তিক পর্যায়ে ট্যুরিজম সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান, যানবাহন, ব্যক্তি পর্যায়ে প্রদত্ত সেবা, পণ্যের বিপরীতে মাত্রাতিরিক্ত মূল্যমান আদায়ের প্রবণতা, হয়রানিমূলক আচরণ সেই সঙ্গে সার্বিক নিরাপত্তাহীনতা, আন্তর্জাতিক ভাষাজ্ঞানসহ এ খাতের উপযোগী অন্যান্য ভাষাজ্ঞান সমৃদ্ধ জনবলের অপর্যাপ্ততা। সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশ বর্তমানে এই খাত থেকে প্রায় ৭৬.১৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বার্ষিক আয় করে। অথচ সার্কভুক্ত অন্য দেশগুলোর পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে দেখা যায়, ভারতে পর্যটন খাত থেকে আয়ের পরিমাণ ১০,৭২৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, মালদ্বীপে ৬০২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, শ্রীলঙ্কায় ৩৮৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, পাকিস্তানে ২৭৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং নেপালে ১৯৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। সুতরাং সার্কভুক্ত অন্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। পর্যটন শিল্পের সবটুকু সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে আদর্শ হতে পারে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন-সম্ভাবনা অপরিসীম। আমাদের রয়েছে সুবিশাল সমুদ্র সৈকত, পাহাড়, অরণ্যঘেরা জলপ্রপাত, হাওর, প্রত্নতত্ত্বের প্রাচুর্য ও ঐতিহাসিক নিদর্শনসহ নানাধরনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থান, যা পৃথিবীর যে কোনো স্থানের পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য যথেষ্ট। এক কথায় বলা যায়, বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলে তথা প্রতিটি জেলাকেন্দ্রিক পর্যটনের যেমন প্রাকৃতিক উপাদান বিদ্যমান সেই সঙ্গে রয়েছে এদেশের অতিপ্রাকৃত, অকৃত্রিম সুখী ও অতিথিবৎসল জনগণ যা পর্যটন দৃষ্টিকোণে একটি বড় ইতিবাচক উপাদান। বাংলাদেশের পর্যটনে প্রচলিত চিন্তাচেতনার বাইরে একটু দেশীয় ছোঁয়া দিতে পারলে অভ্যন্তরীণ পর্যটকের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক পরিবেশই এমন, একটু চেষ্টা করলে সারা দেশটাকেই পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। এতে আরও বলা হয়েছে, পর্যটন শিল্প বিকাশের যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকলেও পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় আমরা ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছি। পার্শ্ববর্তী অনেক দেশ যেখানে এই শিল্পের ওপর নির্ভর করে অর্থনীতি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সেখানে আমরা স্থবির হয়ে আছি। সিঙ্গাপুরের জাতীয় আয়ের ৭৫ শতাংশ, তাইওয়ানের ৬৫ শতাংশ, হংকং এর ৫৫ শতাংশ, ফিলিপাইনের ৫০ শতাংশ, থাইল্যান্ডের ৩০ শতাংশ আসে পর্যটন খাত থেকে। মালদ্বীপের অর্থনীতির বেশির ভাগই আসে পর্যটন খাত থেকে। এ ছাড়া মালয়েশিয়ার বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ৭ শতাংশই আসে পর্যটন খাত থেকে। এক সমীক্ষায় দেখা যায় যে, ২০২৪ সালে মোট কর্মসংস্থানের মধ্যে পর্যটন খাতের অবদান দাঁড়াবে ১ দশমিক ৯ শতাংশ। পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন সেক্টর, যেমন পরিবহন, হোটেল, মোটেল, রেস্তরাঁ, রিসোর্ট, এয়ারলাইন্স ও অন্যান্য যোগাযোগের মাধ্যম থেকে পৃথিবীর অনেক দেশ প্রতি বছর প্রচুর রাজস্ব আয় করে, যা অন্য যেকোনো বড় শিল্প থেকে পাওয়া আয়ের চেয়ে বেশি। পর্যটনবান্ধবের জন্য ৯ বাধার পাশাপাশি বেশকিছু প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে সংসদীয় কমিটিকে। এর মধ্যে রয়েছে- শুধু পর্যটন বিষয়ক একটি পৃথক সংসদীয় কমিটি বা বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির অধীন একটি পৃথক সাব কমিটি গঠন করা যায়। যে কমিটি শুধুমাত্র দেশের পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে একনিষ্ঠভাবে কাজ করবে। এ ছাড়া পর্যটন শিল্প খাতটি একটি উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় খাত বিবেচনায় শুধুমাত্র পর্যটন বিষয়ক পৃথক একটি মন্ত্রণালয় গঠনের উদ্যোগ নেয়ার কথা বলা হয়েছে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য সুপারিশের মধ্যে রয়েছে- পর্যটন শিল্পের সঙ্গে যুক্ত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানকে উৎসাহিত-মনোযোগী-উদ্দীপ্তকরণে ট্যুরিজম শিল্পে উল্লেখযোগ্য কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ বা ‘একুশে পদক’ প্রদানে বর্তমান নির্বাচিত বিষয়গুলোর সঙ্গে পর্যটন খাতকে যোগ করে জাতীয় সম্মাননা বা পুরস্কার প্রদানের বিষয়টি সরকার বিবেচনা করতে পারে। এছাড়া পর্যটন বিকাশ সংশ্লিষ্ট একটি সংক্ষিপ্ত ও উপযুক্ত উক্তি/স্লোগান নির্বাচন করা যায়, যে উক্তি/স্লোগানটি প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী (সকল পর্যায়), সংসদ সদস্যারা তাদের দাপ্তরিক ও রাজনৈতিক বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে উপস্থাপন করবেন। অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ তাদের বক্তব্যে উক্তি/স্লোগানটি যোগ করবেন। সে সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা থেকে অন্যান্য পর্যায়ের কর্মকর্তা, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সকল সরকারি-বেসরকারি কার্যালয়ের কর্মকর্তারা তাদের নিয়মিত দাপ্তরিক সভায় উক্তি/স্লোগানটি উপস্থাপন করবেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- এশিয়ার মধ্যে থাইল্যান্ডে পর্যটন খাত থেকে আয়ের পরিমাণ বেশি হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে বিদেশি পর্যটক। এই অঞ্চলে ভারত এবং শ্রীলঙ্কার পর্যটন আয় বেশি, কারণ তাদের পরিকল্পিত চিন্তাভাবনা। ছোট রাষ্ট্র যেমন- হংকং, সিঙ্গাপুর, ম্যাকাও, মালদ্বীপ, ফিজি পর্যটন খাত থেকে প্রচুর আয় করে শুধু বিদেশিদের আনাগোনার জন্য। এতে বলা হয়েছে, পর্র্যটন এখন অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার খাত। পর্যটকের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিধি ব্যাপকতা লাভ করেছে। পর্যটনের মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধিত হয়ে থাকে। ২০১৭ সালে বিশ্বের জিডিপিতে ট্যুরিজমের অবদান ছিল ১০.৪ শতাংশ, যা ২০১৭ সালে ১১.৭ শতাংশে গিয়ে পৌঁছাবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা ছিল। এ ছাড়া ২০১৭ সালে পর্যটকদের ভ্রমণখাতে ব্যয় হয়েছে ১৮৯৪.২ বিলিয়ন ডলার। আর একই বছর পর্যটনে বিনিয়োগ হয়েছে ৮৮২.৪ বিলিয়ন ডলার। পর্যটনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি খণ্ডচিত্র আমরা এর থেকে পেতে পারি। এতে আরও বলা হয়, পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন সেক্টর যেমন, পরিবহন, হোটেল, মোটেল, রেস্তরাঁ, রিসোর্ট, এয়ারলাইন্স ও অন্যান্য যোগাযোগের মাধ্যম, চিত্তবিনোদন পার্ক, ক্যাসিনো, শপিং মল, সংগীত মঞ্চ ও থিয়েটার থেকে পৃথিবীর অনেক দেশ প্রতি বছর প্রচুর রাজস্ব আয় করে, যা অন্য যেকোনো বড় শিল্প থেকে পাওয়া আয়ের চেয়ে বেশি। বিশ্ব পর্যটন সংস্থার প্রাক্কলন অনুযায়ী, সারা বিশ্বে প্রায় ১০০ মিলিয়নের বেশি মানুষ তাদের জীবন-জীবিকার জন্য এই শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যে দেশ ঐতিহ্যগত, সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক এবং আত্মিক সকল সম্পদ দিয়েই সমৃদ্ধ। এ কারণে সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই বাংলাদেশে পর্যটকদের আগমন ঘটছে। ইতিহাসখ্যাত পর্যটক ফাহিয়েন, হিউয়েন সাং, ইবনে বতুতার পর্যটক হয়ে আসার কাহিনী সবার জানা। বাংলাদেশে পর্যটন কেন্দ্রগুলো বৈচিত্র্যময় হওয়ার কারণে পর্যটকদের মধ্যেও বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা বিরাজমান। এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে আমাদের সকলকে এগিয়ে আসা উচিত।